একবার মামারা রাজরাপ্পার মন্দির থেকে বলির মাংস নিয়ে এল। বড়দিদা রান্না করল পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া। ওভাবে যে পাঁঠার মাংস রান্না করা যায়, সেও আমার রাঁচীতেই দেখা। আর মাংস রাখতে হলে আমরা তো ফ্রিজে রাখি। রাঁচীতে শীতকালে কাঁচা মাংস একরাত রাখতে হলে বালতি করে ঢাকা দিয়ে বারান্দায় রাখা হত। বাইরে যা ঠান্ডা, ওটাই ফ্রিজের কাজ করবে বলে। আরও একটা জিনিস রাঁচীতে শিখেছিলাম। যদি দু’-তিন দিন ধরে ট্রেন বা বাস জার্নি করতে হয়, আর বাইরের খাবার খেতে অসুবিধে থাকে, তাহলে দুধ দিয়ে ময়দা মেখে লুচি করতে হয়। তিনদিন ঠিক থাকে, খারাপ হয় না। সঙ্গে আচার নিতে হবে। নইলে তরকারি অতদিন তো থাকবে না। ... ...
– সুমিতাদিদা আর নিনাদিদা এখন কেমন আছেন, মা? – আছেন বলতে জরাগ্রস্ত, নব্বই ছুঁই ছুঁই। আর নিনাদিদা তো মানসিকভাবে সুস্থ নয়, অল্পবয়সে উত্তমকুমারকে বিয়ে করবে বলে পাগল হয়ে গিয়েছিল। তাই বিয়ে-থাও হয়নি। – মানে? উত্তমকুমারকে বিয়ে করতে চাইতো? – হ্যাঁ, হাসছিস? বহুমেয়েই তখন এমন পাগল ছিল। স্টার থিয়েটারে শ্যামলী দেখে নিনাদিদা পাগল হয়ে গেল। রোজ স্টারের দরজায় বসে থাকত। উত্তমকুমার কখন ঢুকবেন, কখন বেরোবেন। তারপর ধীরে ধীরে বিকার গ্রাস করলো। বলতো, উত্তমকুমার ওকে নিয়ে যাবে। মেহগনি কাঠের কারুকাজ করা পুরোনো ড্রেসিং টেবিলের বিরাট আয়নার সামনে সেজেগুজে বসে থাকতো, উত্তমের সঙ্গে বেরোবে বলে .... ... ...
– জেঠিমা, তার মানে পুতুল দিদা যে এমন হৈ চৈ করে, সেটা মনের দুঃখ ঢেকে রাখার জন্য? এসব এত কিছু তো জানতামই না। – মানুষের মনের খবর কেই বা রাখতে পারে বাবু। – জেঠিমা, তুমি মোহনবাগানের গল্প বলতে গিয়ে বলেছিলে, স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন কুমুদিনী। পুতুলদিদাও কি ভেঙে পড়েছে? – এসব কথা তো আর কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না। বুঝে নিতে হয়। তবে আগের পিসি আর এখনকার পিসির মধ্যে কিছুটা তফাৎ তো আছেই। তোর জেঠুও ঐজন্য সবসময়ে দেখিস না পিসির সঙ্গে টরেটক্কা করে যায়? আগের পিসিকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করে। আর রইল কুমুদিনীর কথা। নিজের কথা তিনি নিজেই বলে গেছেন। ... ...
পরে আমি অনেক ভেবেছি জানিস। সকালের পায়েস, বিকেলে সেটা কয়েকমাসের বাচ্চার পক্ষে বিষ, গ্রামে তো অত ঢাকা-চাপা দেবার অভ্যেস নেই। আর এ বাড়িতে সব কিছু কাজের লোকের ওপরে নির্ভর। রুপোর টাকার কোনো দরকার ছিল না। তাও যখন দেওয়া হল, সেটা মুখে লাগানোর আগে গরম জলে ফুটিয়ে নেওয়া দরকার ছিল। আর এ জায়গাটা ঊপকূল। ভূগর্ভস্থ জলস্তর মাটির খুব কাছে। বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে প্রাকৃতিকভাবে ফিল্টার হওয়ার সুযোগ পায় না। তাই জলের কোয়ালিটি খুব খারাপ। এখন আমরা বড়রা কেনা জল খাই। ঐ জলে ধুয়ে বাচ্চার মুখে দেওয়া অন্যায় হয়েছিল। আমি কিন্তু তখন প্রফেসর। পুঁথিগত জ্ঞান-বিজ্ঞান সবই জানা ছিল। কিন্তু আমি হাতেকলমে রান্নাবান্না নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। বইয়ের জগতে বাস করতাম। সবকিছুতে বড়দের ওপরে নির্ভর করে চোখ বুজে বসে থাকতাম। আমি তখন মা হয়েছি, তবে প্রকৃত মা হতে পারিনি। অযোগ্য ছিলাম। সেই ঘটনা থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, রান্না আমায় শিখতে হবে। আর হেঁশেলে কর্ত্রী হতে হবে। মূর্খ রাঁধুনিদের ওস্তাদি বন্ধ করতে হবে। আর সন্তানের খাওয়া দাওয়ার জন্য গুরুজন, লঘুজন কারোর ওপরে ভরসা করব না, ভগবান এলেও না। ... ...
অনেকক্ষণ থেকেই দেখছিলাম, ছোট জা আমাকে চোখ মটকাচ্ছে। ... একটু দূরে আছে বলে ওর ইশারা বুঝতে পারিনি, খাওয়ার দিকেই একতানমন হয়ে ছিলাম। পরে কথা বলে বুঝলাম, জা আমার খাওয়া দেখে ইশারা করছিল, এখনই অতটা পরিমাণ খেয়ে না নিতে। ওর কথাটাকে সত্যি করে, চাটনির পরে এল সাদা ভাত আর ঘি। তারপর একে একে পোস্ত ছড়ানো লাল শাক ভাজা, মুড়োর ডাল, ছ্যাঁচড়া, মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস, ঘন টমেটোর চাটনি, দই, মিষ্টি, পান। এমন দুই পর্বের খাওয়া দেখে, খেয়ে আমার মনটা ভীষণ অবাক, আর পেটটা খুব ক্লান্ত হয়ে গেল। ... ...
এখানে বা কলকাতায় সরভাজা, সরপুরিয়া পাওয়া যায় না? আমি খেতাম তবে। - এখানে না, তবে কলকাতায় পাওয়া যায়। উত্তর কলকাতার বিখ্যাত দোকান নদীয়া সুইটস, আমার মায়ের হট ফেভারিট। সেখানে পাওয়া যায়। - ও, তাহলে তো কলকাতাতেই খেয়ে নেব। কৃষ্ণনগর যেতে হবে না। - আরে পাগলি, এক এক জায়গার এক এক স্পেশালিটি। অধর দাসের সরপুরিয়ার সোয়াদ কোনোদিনই অন্য দোকানে পাওয়া যাবে না। - কেন পাওয়া যাবে না? একই তো মিষ্টি। - না রে বাবু। কোনো জায়গার মিষ্টি সোয়াশ’ বছর ধরে জনপ্রিয় – এ কি কখনও এমনি এমনি হয়? আমরা তো সার্ভের কাজে গিয়েছিলাম। তখন এই দোকানের বিষয়ে অনেক কাহিনী শুনেছিলাম। এই দোকানটা উত্তম-সুচিত্রার সবার উপরে সিনেমাতেও আছে। - তাহলে তো ঐতিহাসিক দোকান বলা যায়। মিষ্টিটা কেমন খেতে? কী দিয়ে তৈরি? কীভাবে বানানো হয়? ... ...
রুনাদা আসলে খিচুড়ি হোক, কি মাংস – রান্নার স্বাদটা দারুণ করে। তার কারণ আমিষ নিরামিষ কী সব সিক্রেট মশলা বানিয়ে রাখে। কাঁচা এবং ভাজা দু’রকম। কাঁচা মশলা রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে, ওটা দিয়ে রান্না হয়। আর ভাজা মশলা উনুনের আঁচে চাটুতে শুকনো ভেজে গুঁড়ো করে বানায়। ওটা রান্না হয়ে গেলে ওপর থেকে ছড়িয়ে দিতে হয়। ধীরে ধীরে মিশে যায়। মশলাগুলো বানিয়ে যত্ন করে আলাদা আলাদা কাগজে মুড়ে কৌটোয় তুলে রাখে, যাতে গন্ধ না উড়ে যায়। এই রান্নাঘরের মাইনে করা মেয়ে বৌদের ঐ মশলা ছোঁয়ার জো নেই। রুনাদার ধারণা, এই মশলা ওদের হাতে পড়লে নষ্ট হবে। যেখানে সেখানে খোলা রেখে দেবে, হয়তো বেশি ঢেলে দেবে বা কম। সবচেয়ে বড় কারণটা অবশ্য মুখে বলে না। যদি আঁচলে ঢেলে নিয়ে পালায়, এত কষ্টের জিনিস। ... ...
আমুদী মাছটাও বেশ সুস্বাদু। বিয়ের আগে খাওয়া দূরস্থান, এসব মাছের কখনও নামও শুনিনি আমি। একটু ছোট আকারের লালচে স্বচ্ছ ধরণের চেহারা মাছটার। নুন-হলুদ মাখিয়ে ভাজা হয়, তবে ফ্যাসার মত কড়া করে নয়। সর্ষের তেলে কয়েক দানা চিনি ফেলে শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দেওয়া হয়। পেঁয়াজ কুচো, আদা রসুন বাটা, হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে কষে তেল ছেড়ে গেলে টমেটো বাটা মেশায় রুনাদা। আবার মশলাটা কষে। এইভাবে দু’বার করে কষে ধৈর্য ধরে এক একটা রান্না করে রুনাদা, আমি দেখি। এবার অল্প জল দিয়ে মাছগুলো ঢেলে দেয়। এবারে বেশ ছ’-সাতটা নধর কাঁচালঙ্কা আস্ত আস্ত ঝোলে ফেলে চাপা দিয়ে দেয়। আর এমন চৌখস, উনুন থেকে কড়া নামিয়ে দেবে ঠিক সময়ে, কিন্তু ঢাকা খুলবে না। পুরো ভাপটা ঠান্ডা হয়ে রান্নার ঝোলে ঢুকে যাবে। আর খাওয়ার সময়ে ঝোলে একটা অসাধারণ কাঁচালঙ্কার গন্ধ বেরোয়, কিন্তু ঝাল হয় না। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি রান্নায় ঐ কাঁচালঙ্কার ফ্লেভার আনার, এখনও সফল হতে পারিনি। ... ...
- উড়িষ্যার ভিতরকণিকায় অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড থেকে হাজার হাজার অলিভ রিডলে প্রজাতির কচ্ছপ আসে ডিম পাড়তে – সেটা জানিস তো? - হ্যাঁ। - কিছু কচ্ছপ জেলেদের জালে ধরা পড়ে যায়। আর চোরাশিকারিরা তো আছেই। তারা ঐ কচ্ছপ ধরে। এই এলাকার লোক কচ্ছপ খায়, মানে এমনি তো পায় না। কচ্ছপ ধরা, বিক্রি নিষিদ্ধ। কিন্তু পেলে ছাড়ে না। আর বড় অলিভ রিডলেকে বলে বালিগড়। একটা বালিগড় চোরাগোপ্তা পেয়ে গেলে এদিকের মানুষের ঘরে উৎসব লেগে যায়। গতকাল আমাদের যে দুর্গাবৌদি রান্না করে, সে খুব হেসে হেসে নাতিকে কোলে নিয়ে বলছিল, “তুমি কী খেয়েছ?” বাচ্ছাটা আধো আধো করে বলছে – বালিগল। ... ...
- দেখ মা, আমাদের বাড়িতেও গোপীনাথ কৃষ্ণ। আবার তোমার আড়বালিয়ার বাড়িতেও যে সতীমা, আউলচাঁদ – সেখানেও কৃষ্ণের প্রভাব তুমি বলেছিলে। সারা বাংলা জুড়ে এত কৃষ্ণ কী করে এল মা? কৃষ্ণ তো মথুরা, বৃন্দাবনের লোক – মানে উত্তর প্রদেশের। মৃত্যু গুজরাটে। পশ্চিম থেকে এভাবে পূর্বে চলে এল? - সে তো আসবেই। এক দেশ, এক সংস্কৃতি। কিন্তু তুই যেটা ভাবছিস কৃষ্ণের প্রভাব – পুরোটা তা নয়। বহিরঙ্গে আমরা অনেক বেশি দুর্গাপুজো আর কালীপুজো করছি। মাছ, মাংস খাওয়ারও কমতি নেই। কিন্তু গৃহদেবতা হিসেবে যে কৃষ্ণ থেকে গেছেন, সেটা হল চৈতন্যের প্রভাব। - শ্রীচৈতন্যদেব? কিন্তু তাঁর কথা তো খুব একটা ভাবি না। মানে আলাদা করে তাঁর পুজো বা স্মরণ – এসব তো হয় না। - হয়, তুই বুঝতে পারিস না। - কেন বুঝতে পারব না? তুমি বোঝাও। ... ...
- যাই বল জেঠিমা, মেয়ের বিয়েতে নিরামিষ হওয়াটা কিন্তু মেনে নেওয়া যায় না। মেয়েদের কী দোষ? - দোষ গুণের কথা নয়, এ হল এক একটা পরিবারের রীতি। - তাই বলে, মেয়ের বিয়েতে কোফতা কাটলেট, ফ্রাই, কালিয়া, পাতুরি কিচ্ছু হবে না? সব ছেলেদের হবে? - কেন হবে না? সব হবে। - কী করে হবে? বলছ তো নিরামিষ। - নিরামিষে তুই যা যা বললি – সব হয়। - অসম্ভব। - হয় রে হয়। এঁচোড়ের, মানে গাছ পাঁঠার কালিয়া হয়, ছানার পাতুরি হয়, লাউ পাতায় মশলা পোরা পাতুরি হয়, মুড়িঘণ্টের বদলে মোচার চণকান্ন, চালপটল হয়, কাঁচকলার কোফতা, থোড়ের কোফতা হয়, আর কাটলেট কত নিবি? বিটের কাটলেট, সয়াবিনের কাটলেট, পনির কাটলেট, বাঁধাকপির কাটলেট – সব হয়। মাশরুমের ফ্রাই দারুণ খেতে হয়। তাছাড়া পটলের দোরমা, ওলের ভর্তা – এসবও হয়। আমাদের দেশে নিরামিষ রেসিপি আমিষের থেকে কম কিছু নেই। ... ...
- এই দেখ, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাঙালি বিয়ের ভোজ নিয়ে কী লিখছেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত: ‘কলাপাতায় বড় বড় লুচি আর কুমড়োর ছক্কা। কলাপাতার এক কোণে একটু নুন। মাসকলাই ডালের পুরে আদা মৌরি দিয়ে কচুরি, নিমকি, খাজা, চৌকো গজা, মতিচুর এইসব সরায় থাকিত। আর চার রকম সন্দেশ থাকিত। আগে গিন্নিরা নিজেরাই রাঁধিতেন। কিন্তু একদল লোক খুঁত ধরে ভোজ পণ্ড করে দিত বলে মেয়েরা আর রাঁধিতেন না। ’ - একদল লোক খুঁত ধরে খাওয়াদাওয়া পণ্ড করে দিত? - হ্যাঁ রে, নিন্দেমন্দ, খুঁত ধরা, গাল পাড়া, ঘোঁট পাকানো, জাতপাত তুলে ভোজ বয়কট – এইসব নষ্টামি খুব ছিল। - এ বাবা! - আবার এটা কি জানিস, কলকাতার বিয়েবাড়িতে অনেক দুষ্ট লোক যেত জুতো চুরি করতে। সেই জন্য গৃহকর্তার সঙ্গে চাকরও যেত জুতো পাহারা দিতে। বিয়েবাড়ির সামনে ঘোড়ার গাড়ি আর পালকির পার্কিং প্লেস বানাতে হত। - হি হি। ... ...
আমার কর্তা বলে, যে ওরা প্রায়ই ছোটবেলায় নারকেল তেলে ভাজা লুচি খেত। খুবই স্বাভাবিক। কারণ উপকূল অঞ্চলে নারকেল খুব সুলভ। বাড়িতেই তেল বানানো হত। আমার খুব আগ্রহ ছিল – এই তেল বানানোর পদ্ধতিটা নিজের চোখে দেখব। আমাদের রান্নাঘরের মতি বৌ নারকেল তেল বানিয়ে আমার সেই ইচ্ছে পূরণ করেছে। ব্যাপারটা দেখলাম তেমন শক্ত কিছু নয়। নারকেল কুরে গরম জলে ফেলে দুধ বের করতে সকলেই জানে। এক্ষেত্রে খুব ঝুনো নারকেল যেগুলোর জল শুকিয়ে ফোঁপর বেরিয়ে যায়, অঙ্কুরোদ্গম হয়ে যায়, তেমন কয়েকটা নারকেল ধৈর্য ধরে কুরে নিতে হবে। তারপরে রাঁধুনিরা সেই কোরা নারকেল গরম জলে কিছুক্ষণের জন্য ভিজিয়ে রাখল। আধঘণ্টা-খানেক পর, ঐ জলেই বেশ দু’-তিনবার ভাল করে কোরা নারকেল চটকে দুধ বার করে নিল। এইবার এই দুধটুকু কড়ায় ফোটাতে ফোটাতে জল সব বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে, তেলটুকু ভেসে উঠবে। রাঁধুনিদের অনুরোধে তেল থেকে ছেঁকে নেওয়া বাদামি রঙের নারকেলের ছিবড়ে খেয়ে দেখলাম। এখানে বলা হয় নারকেলের চড়া। মিষ্টি মিষ্টি বেশ খেতে। ... ...
এ বাড়িতে পশু পাখিকে, গাছকে, ঘাসকে, পুকুরের মাছকে খেতে দেওয়ার, সম্মান করার এক প্রাচীন প্রথা আছে। আমার বাপের বাড়ির গ্রাম আড়বালিয়াতে এমন কখনও দেখিনি। সেই প্রথা হল গমা পূর্ণিমাতে প্রকৃতি পুজো। পুজোতে সকল পশুপাখির প্রতিনিধিত্ব করে গমা বুড়ি অর্থাৎ গোমাতা। এইদিন খুব সকালে গোয়ালের যত গরু আছে তাদের পরিষ্কার করে স্নান করিয়ে দুই শিঙে রাখী বেঁধে দেওয়া হয়। সারাদিন ধরে পুজোর জন্য আস্কে পিঠে তৈরি করা হয়। সেদ্ধ চাল আগের দিন সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সকাল সকাল বেটে নেওয়া হয়। এবার তাতে একটু নুন আর অল্প অল্প করে গরম জল মিশিয়ে খুব ভালো করে ফেটানো হয়। কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে রাখা হয়, যাতে মণ্ডটা একটু ফেঁপে যায়, তারপর মাটির সরায় পাতার জ্বালান দিয়ে একটা একটা করে আস্কে পিঠে তৈরি হয়। ... ...
উনি নাকি লিফলেট ছাপাতেন। তাতে সহজ বাংলায় লেখা থাকতো স্বাস্থ্য বিধি, তারপরে মেয়েদের কেন লেখাপড়া করা দরকার, দেশের ভালোর জন্য কী কী করা উচিত - এইসব। বাগবাজারের বিশ্বকোষ লেনে একটা প্রেস ছিল। সেই প্রেসে ছাপানো হত। কুমুদিনীর বই দুটোও ঐ প্রেসেই ছাপানো হয়েছিল। তাছাড়া অন্য লেখালেখি ছিল। পরিবারের সকলেই বলেছে, কিন্তু চোখে কিছু দেখিনি। আর একথাও শুনেছি, লেখালেখির থেকে ওঁর নিজস্ব উপার্জন ছিল। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মা বলেছিল, উনি শোভাবাজার রাজবাড়িতে থাকা কালীনই নিয়মিত সাহিত্য সভা করতেন। সেখানে সমাজের বড় মানুষেরা আসতেন। ধীরে ধীরে সেইসব সংসর্গে আরও অনেক সভা সমিতির কাজে জড়িয়ে পড়েন। সবগুলো নিরামিষ সাহিত্যের ব্যাপার ছিলনা। সেখানে সক্রিয় ইংরেজ বিরোধিতার গল্প ছিল। স্বামী শরৎ মারা যাবার পরে, উনি যে রাজবাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, তার এটাও একটা কারণ। শরতের দাপটে সব চুপ থাকতো। কিন্তু তিনি না থাকাতে পরিস্থিতি ঘুরে গেল। ... ...
- সেনবাড়ির ঝোল আর মাছের ঝালের তফাৎটা কি? - তফাতের বদলে তুলনা বলছি। ১। দুটোতেই তেলে পাঁচফোড়ন আর লঙ্কা ফোড়ন পড়ে। কাঁচা লঙ্কা অথবা শুকনো লঙ্কা - আপরুচি খানা। মা কাঁচা লঙ্কা দিত, আমিও তাই। ২। ঝোলে নানারকম সব্জি দেওয়া যাবে। কিন্তু ঝালে সেটা হয়না। ঝালে আমার মা মাঝে মাঝে আলু বা বেগুন, অথবা শীতের সময়ে পেঁয়াজ কলি বা কচি শিম ভেজে দিতো, যেকোনো একরকম। ৩। আজকাল সারাবছর টমেটো পাওয়া যায় বলে, দুটোতেই টমেটো দেওয়ার চল হয়েছে। আমাদের ছোটবেলায় টমেটোর এত ব্যবহার ছিলনা। ৪। হলুদ দুটোতেই কমন। ৫। ঝোল বা ঝাল হবে নোনতা স্বাদের। কোনো মিষ্টি পড়বেনা। ৬। ঝোলের মশলা হচ্ছে প্রধানত ধনে; জিরে দিলে খুব অল্প, মা জিরে দিতনা। ডালনা বা দমে জিরে হল প্রধান, কিন্তু ঝোলে নয়। বেগুন দিয়ে ঝোল হলে হাল্কা সর্ষে ধোওয়া জল দেওয়া যাবে। ... ...
তরকারিতে নুন কম বেশি হলে কী করতে হয় গো মা? – কম হলে খুব একটা অসুবিধে নেই, দিয়ে খাওয়া যায়। বেশি হলে বিপদ। – বেশি হলে কী করব? – রান্না অনুযায়ী হবে। ধর, মাংসের ঝোলে নুন বেশি হয়েছে। তখন গরম জল মিশিয়ে ঝোল পাতলা করতে পারিস। যদি দেখিস আর জল মেশালে গামছা কাঁধে ঝোল পুকুরে নামার অবস্থা হবে, তখন এক দেড় চামচ টক দই, এক চিলতে হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো আর ময়দা মিশিয়ে দিতে পারিস। টকে নুন টেনে নেবে, ঝোলও পাতলা হবে না। দইয়ে হলুদ, লঙ্কা মিশিয়ে দিলে রংটাও হাল্কা হবে না। আবার ধর ঘুগনি জাতীয় কিছুতে নুন বেশি হলে তেঁতুল গোলা জল বা লেবুর রস মেশানো যেতে পারে। যদি টমেটো দেওয়া রান্না হয়, তবে টমেটো ঘিসনিতে ঘষে পিউরি বানিয়ে আলাদা ফোড়ন কড়ায় একটু ফ্রাই করে মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। হাল্কা ফ্রাই না করলে আবার কাঁচা টমেটোর গন্ধ উঠবে। ... ...
আচ্ছা জেঠিমা, আমরা তিনজন যে মোহনবাগানের মেয়ে হলাম, সেটা কি ধোপে টিকবে? কেন? টিকবে না কেন? আমরা যে খুব ইলিশ খাই। তাতে কী? মোহনবাগানীরাও ইলিশ খায়, ইস্টবেঙ্গলীরাও চিংড়ি খায়। তাতে ভালবাসা কমে না। লাবণ্যর হাতের একটা রেসিপি করতে পারি, খাবি? কৃষ্ণার কাছে শিখেছি, কাঁচা ইলিশের ঝাল। মা, রান্নাটা কিন্তু দেখব, কীভাবে কর। কুমুদিনী-লাবণ্য-কৃষ্ণা-শারদা – আর একটা নাম জুড়ে যাবে রঞ্জাবতী। মানুষ থাকবে না, রান্নার ঘরানা চলতে থাকবে। কাল কাঁচা ইলিশের ঝাল করলে পরশু ডাব চিংড়ি করবে জেঠিমা। ঠিক হ্যায়, করতেই হবে। আজ ইস্টবেঙ্গলী ইলিশ রান্না হলে কাল তো মোহনবাগানী চিংড়ি রান্না হতেই হবে। তাহলে আমি ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিচ্ছি, কাল, পরশু বাড়িতে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের নামে ফুটবল – খাদ্য উৎসব হবে, অরগানাইজড বাই আওয়ার টু প্রিন্সেসেস। ... ...
টকে তরিবত বলতে শেষে একটু ভাজা মশলার গুঁড়ো দেওয়া যায়। আর কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামানো হয়। আসলে মাছ কাটার সময়ে বলে দিতে হয়, ক’পিস হবে। তোর বাবা বাজার এনেই খালাস। কিছু দেখে না। তুই শিখে নে। আস্তে আস্তে চেষ্টা করতে করতে দেখবি হেঁশেলের কন্ট্রোল হাতে চলে এসেছে। আর এখানেও অনেক লোক তো। বড় পিস করে ভাপা করা মুশকিল। তাই এখানেও ছোট পিস কাটা হয়। তবে আমি তোর সঙ্গে একমত। ইলিশ না খেলে না খাব। একদিন খাব তো বড় টুকরো খাব। ... ...
– ব্রাহ্ম বৌরা বুঝি সিঁদুর পরে না জেঠিমা? – সঠিক জানি না, তবে না পরাই উচিত। বইতে পড়েছি, ১৮৫০ নাগাদ যে ব্রাহ্ম বিবাহ আইন হয়, তাতে আন্তর্বর্ণ বিবাহ ও বিধবাবিবাহ সমর্থন, বাল্যবিবাহ রদ, স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক দ্বিতীয় বিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ এবং বিবাহবিচ্ছেদ স্বীকৃত ছিল। বিবাহের রীতি হিসেবে বলা যায়, সাবালক পাত্র-পাত্রীরা ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে উপস্থিত হয়ে স্ব-স্ব ধর্মে বহাল থেকে ব্রাহ্ম রীতিতে সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু সাবালক হবার বয়স ধরা হয়েছিল চোদ্দো বছর। ব্রাহ্ম বিয়েতে সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলায় মন্ত্রোচ্চারণ হয়৷ শেষে বর-কনে, অভিভাবক, উপস্থিত অতিথিরা প্রার্থনা সভায় অংশ নেন এবং ব্রাহ্ম সংগীত গেয়ে বর-কনের মঙ্গল কামনা করেন। যৌতুক দেওয়া নেওয়া ও বিরাট লোক খাওয়ানো, বিলাসিতা, আড়ম্বর এসব চলে না। ... ...